বই: #বিষাদসিন্ধু
লেখক: মীর মশাররফ হোসেন
প্রেক্ষাপট: কারবালার যুদ্ধ
রিভিইউ লিখেছেনঃ তাজমীরা ইয়াসমিন মুক্তা।
ডাউনলোড লিংক: ডাউনলোড বিষাদ সিন্ধু. pdf
নবী মোহাম্মদ (সা:) একবার সাহাবীদের সঙ্গে বসে কথা বলছিলেন, এমন সময় তাঁর দুই নাতি বালক হাসান ও হোসেন তাঁর কাছে এসে নতুন জামা কিনে দেওয়ার জন্য বায়না করতে থাকে। নবীজী তাদের কে স্নেহপূর্বক জিজ্ঞাসা করেন কি ধরণের জামা তারা নিতে চায়, তখন বালক হাসান একটি সবুজ জামা এবং বালক হোসেন একটি লাল রঙের জামা আবদার করে। এমন সময় স্বর্গীয় দূত নবীর নিকট আবির্ভূত হয়ে সৃষ্টিকর্তার আদেশ প্রকাশপূর্বক প্রস্থান করেন, যা শুনে নবীজীর মুখ গম্ভীর হয়ে যায়। তখন সামনে বসে থাকা সাহাবী এবং অনুসারীরা নবীকে জিজ্ঞাসা করতে থাকে জিব্রাইল( আ:) কি এমন সংবাদ দিল যার জন্য নবীজীর মুখে এমন ঘোর অমানিশার ছাপ পড়লো!! তাদের আকুলতা দেখে নবীজী একসময় মনের কথা প্রকাশ করে যে, সৃষ্টিকর্তার বিধান এই যে নবীজীর অনুসারীর মধ্যে একজন সত্যিকারের ঈশ্বরভক্ত 'মাবিয়ার' বংশে এক পুত্রসন্তান জন্ম নেবে যার দারা মোহাম্মদীয় বংশের সুখসূর্য অস্তমিত হবে এবং যার দ্বারা হাসান হোসেনের প্রাণপাত হবে।
এই কথা শুনে মাবিয়া দুঃখে অধীর হয়ে বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত নিল! কিন্তু তার সেই প্রতিজ্ঞা ঈশ্বরের মহিমায় সফল হলো না। এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে সে বিয়ে করতে বাধ্য হলো। ঈশ্বরের মহিমায় চল্লিশোর্ধ মাবিয়ার স্ত্রী , যার কিনা সন্তান জন্ম দেওয়ার কোন সম্ভাবনাই ছিলো না সে এক পুত্রসন্তানের জন্ম দিল!!
দুশ্চিন্তায় অস্থির মাবিয়া নবীবংশ রক্ষার নিমিত্তে নিজ সন্তান হত্যা করার সিদ্ধান্ত নিল! কিন্তু শিশু পুত্রের নিষ্পাপ মুখের দিকে তাকিয়ে তার সে পরিকল্পনা ও ব্যর্থ হলো। শেষে সে শিশুপুত্র এজিদকে নিয়ে মদিনা ছেড়ে বহুদূর দামেস্ক যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল! দামেস্ক ছিলো হাসান হোসেনের পিতা হযরত আলীর বিজিত রাজ্য। হযরত আলী তা মাবিয়াকে দান করে দিলেন যাতে মাবিয়া এজিদকে নিয়ে হাসান হোসেনের জীবন থেকে অনেক দূরে চলে যায়।
কিন্তু ঈশ্বরের বিধান অলঙ্ঘনীয়! ক্রমে ক্রমে এজিদ বয়ো:প্রাপ্ত হলো। যুবক এজিদের দৃষ্টি কাড়লো জয়নাব নামে এক রুপবতী রমনী!! এজিদের চোখের ঘুম হারাম হয়ে গেল! জয়নাবের বিরহে খাওয়া দাওয়া ঘুম সব বিসর্জন দিয়ে মলিন মুখে দিনযাপন করতে লাগলো। যে কোন মূল্যে জয়নাবকে জয় করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠলো। এদিকে জয়নাব বিবাহিত!! জয়নাবের স্বামী প্রসিদ্ধ ব্যবসায়ী। অর্থ-জশ উপার্জনের চিন্তায় সদা নিমগ্ন! জয়নাবকে সে ভালোবাসে , আর কি প্রকারে জয়নাবকে আরও অর্থসুখ দেওয়া যায় সে চিন্তায় মগ্ন থাকে সর্বক্ষণ। জয়নাব কিন্তু অল্পতেই সুখী! অর্থের মোহ তার নেই। স্বামী নিয়ে সে সুখেই ঘর করছিলো।
জয়নাবের স্বামীর অর্থের প্রতি লোভকে কাজে লাগালো এজিদ। ছলনা করে তাকে দিয়ে জয়নাবকে তালাক দেওয়ালো, নিজের জয়নাব লাভের পথ পরিষ্কার করলো। কিন্তু বিধি বাম! এত কিছু করেও এজিদ জয়নাব লাভে সফল হলো না!
ভাগ্যক্রমে জয়নাবের পাণি গ্রহণ করলো নূরনবী মোহাম্মদ (সা:) এর বড় নাতি ইমাম হাসান!
শুরু হলো দ্বন্দ্ব! সৃষ্টিকর্তার নির্ধারণ করে রাখা পূর্বপরিকল্পিত দ্বন্দ্ব! রোষে অধীর এজিদ হিংসায় ক্ষোভে মত্ত হয়ে একে একে হাসান, হোসেনসহ ইমামবংশীয় মদিনার বীরদের নিশ্চিহ্ন করতে উঠে পড়ে লাগলো! মিথ্যা বলে, ষড়যন্ত্র করে, ছলনার আশ্রয় নিয়ে যেভাবে পারল এক এক করে জয়নাব কে আশ্রয়দাতা সকলকেই সে মৃত্যুবরণ করতে বাধ্য করে শেষে ঈশ্বরের অভিশাপে চির অশান্তির অনলে আত্মাহুতি দিল তবু শেষ হলো না গল্পের! বিষাদ সিন্ধু পার হয়েও পার হওয়া গেল না! বরং নতুন এক বিষাদে অন্তর নিমজ্জিত হলো!
কি সেই বিষাদ? তবে কি এজিদের পরিণতিতেই পাঠকহৃদয়ে সে বিষাদের উত্পত্তি!! তা কি করে হয়, এজিদের মৃত্যুই তো বিষাদসিন্ধুর পাঠকের আকাঙ্ক্ষিত হওয়ার কথা! তাহলে? তবে কি সেই পরিণতি মৃত্যু থেকেও ভয়ংকর! কি সেই পরিণতি! নাকি কি অন্য গল্প আছে সেখানে!!!!!
গল্পের প্রতিটি পর্বেই আছে টুইস্ট!! সব থেকে বেশী সেটা এজিদের পরিণতিতে আর তার থেকেও বেশী আবু হানিফার পরিণতিতে! কে এই আবু হানিফা! যার জন্মের কথা গোপন করেছিলো তার জগত বিজয়ী পিতা! কেন? কার ভয়ে!! তবে কি সে সময়েও মনীষীরাও আপন পত্নীর ভয়ে ভীত ছিলেন!!
গল্পটা যখন পড়তে শুরু করেছিলাম তখন ভেবেছিলাম কারবালার যুদ্ধ হয়তো কোন আদর্শিক যুদ্ধ! আদর্শগত কারণে ইমামবংশীয় হাসান হোসেনের সাথে এজিদের সংঘর্ষ হয়!
পড়তে গিয়ে জানলাম ইতিহাসে এত হৃদয়বিদারক একটা যুদ্ধ তা কিনা শুরু হয়েছে এক নারীহৃদয় লাভের উদ্দেশ্য কে কেন্দ্র করে!
এই উপন্যাসে কারবালার প্রান্তরে হোসেন পরিবারের যে পরিণতির বর্ণনা দেয়া হয়েছে তা পড়ে যে কোন পাষাণ হৃদয়েও বিষাদের ছায়া পড়তে বাধ্য!!
পড়তে গিয়ে বারবার দীর্ঘনিঃশ্বাস জন্মেছে আর গভীর কষ্টে বারবার মনে হয়েছে কার প্রতি রাগ করব! কার কাছে বিচার চাইব! কার বিচার চাইব! এ তো সেই দয়াময়েরই পরিকল্পনা! তবে কি....
পরিশেষে এই গল্পে যেভাবে যুদ্ধের বর্ণনা দেয়া হয়েছে তাতে মনে হয়েছে নবীজী যে যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য এতকিছু করলেন তার অনুপস্থিতিতে সেই যুদ্ধকেই এত গরিমার সাথে বর্ণনা করা হচ্ছে! মুসলমান যোদ্ধাদের বীরত্বগাথা এমনভাবে বর্ণনা করা হচ্ছে যা একদিক দিয়ে সেই শান্তিচিন্তার পরিপন্থী!! তারপরও উপন্যাস উপন্যাসই! এখানে নায়ক এবং নায়ক পরিবারের বীরত্বগাথা কিছু অতিমাত্রায় প্রকাশ পাওয়ায় স্বাভাবিক! এখানে লেখকেরও কিছু পক্ষপাতমূলক কারসাজি থাকে। তাছাড়া উপন্যাসের শুরুতেই বলা হয়েছে ধর্মীয় ইতিহাসকেন্দ্রিক হলেও এটি কোন ধর্মগ্রন্থ নয় বরং এটি একটি বাংলাসাহিত্যের এক অনবদ্য সৃষ্টি যেখানে লেখক তার লেখনী প্রতিভা দিয়ে একটি ঘটনাকে সাহিত্যে রূপ দিয়েছেন!
তাই সব মিলিয়ে সব শ্রেণীর বাঙালী পাঠকের জন্য এটি নিঃসন্দেহে একটি সুখপাঠ্য সাহিত্য উপাদান !
বুক রিভিইউঃ বিষাদ সিন্ধু [ডাউনলোড লিংক]
Reviewed by তৌহিদ আজগর - Tawhid Azgor
on
২:০৪ AM
Rating:
কোন মন্তব্য নেই:
Good books